বিশ্ব খাদ্য ফোরামে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বান:
রোমে এফএও সদর দপ্তরে বিশ্ব খাদ্য ফোরামে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ।
রোকন পাঠান
বস্টন বাংলা ডেস্ক, ১৩ অক্টোবর ২০২৫।
বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রচলিত মুনাফাকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের আহ্বান জানালেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর সদর দপ্তরে আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য ফোরামের (World Food Forum) পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সোমবার তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন।
“খাদ্য মানে শুধু ক্যালরি নয়, এটি মর্যাদা ও ন্যায়ের প্রশ্ন”
ভাষণের শুরুতেই প্রফেসর ইউনূস এফএও-র ৮০ বছর পূর্তিকে “উদ্যাপন নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রস্তুতি” বলে উল্লেখ করেন। তিনি এফএও মহাপরিচালক ড. কু ডংইউ-কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন—এই ফোরাম আলোচনার নয়, কর্মের মঞ্চ। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘Hand in Hand for Better Food and a Better Future’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—খাদ্য শুধু ক্যালরির হিসাব নয়; এটি মর্যাদার, ন্যায়ের, এবং আমরা কেমন পৃথিবী চাই তার প্রতিফলন।
বাংলাদেশ: অর্ধেক ভূমি, দ্বিগুণ সাফল্য
বাংলাদেশের সাফল্যের প্রসঙ্গে তিনি বলেন—ইতালির অর্ধেক আয়তনের এক দেশে আমরা ১৭ কোটি মানুষকে খাদ্য দিচ্ছি, পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দিচ্ছি। তিনি জানান, বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিশ্বের অন্যতম শাকসবজি ও মিঠাপানির মাছ উৎপাদক দেশ। দেশে ১৩৩টি জলবায়ু সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে, কৃষ mechanization-এ দেওয়া হচ্ছে ৭০% পর্যন্ত ভর্তুকি, এবং ফসল উৎপাদনের ঘনত্ব বেড়েছে ২১৪ শতাংশে।
ক্ষুধা উৎপাদনের ঘাটতিতে নয়—অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতায়
তিনি বলেন, ২০২৪ সালে ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল। অথচ পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদন হয়েছে পর্যাপ্তেরও বেশি। এটি উৎপাদনের ব্যর্থতা নয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা — এক নৈতিক ব্যর্থতা। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যেখানে ক্ষুধা নির্মূলে আমরা কয়েক বিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে পারি না, সেখানে বিশ্ব অস্ত্র কেনায় ব্যয় করছে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এটাই কি উন্নতির সংজ্ঞা?
ছয়টি প্রস্তাব: বৈশ্বিক পরিবর্তনের রূপরেখা
তিনি বিশ্ব খাদ্য ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য পুনর্গঠনে ছয়টি পদক্ষেপ প্রস্তাব করেন:
১. ক্ষুধা–সংঘাত চক্র ভাঙা — যুদ্ধ বন্ধ করে সংলাপ ও খাদ্যের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
২. এসডিজি অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ — জলবায়ু পরিবর্তনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
৩. আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক — খাদ্য সরবরাহে স্থিতিশীলতা আনা।
৪. যুব উদ্যোক্তা সহায়তা — অর্থায়ন, অবকাঠামো ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব।
৫. রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার — খাদ্য বাণিজ্যকে নিরাপত্তাবান্ধব করা।
৬. প্রযুক্তি প্রবেশাধিকার — গ্লোবাল সাউথের তরুণ ও নারী কৃষকদের জন্য উদ্ভাবনের সুযোগ।
সামাজিক ব্যবসা: মানবিক অর্থনীতির নতুন পথ
পুরনো মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ কোটি মানুষকে পিছিয়ে দিয়েছে। এখন প্রয়োজন এমন এক ব্যবসা, যা মুনাফার জন্য নয়, সমস্যা সমাধানের জন্য। সেটাই সামাজিক ব্যবসা। তিনি “Three-Zero World” ধারণা উপস্থাপন করেন—Zero Wealth Concentration (সম্পদ বৈষম্যহীন সমাজ), Zero Unemployment (সবার জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ), এবং Zero Net Carbon Emission (জলবায়ু ভারসাম্য রক্ষা)। তিনি উদাহরণ দেন গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ দানোনের সাফল্যের—যেখানে সামাজিক ব্যবসা বাস্তবে পরিবর্তন এনেছে।
তরুণ প্রজন্ম: পরিবর্তনের নেতৃত্বে
আজকের তরুণরা সৃজনশীল, সংযুক্ত এবং প্রযুক্তিতে দক্ষ। তাদের আমরা চাকরিপ্রার্থী নয়, চাকরিদাতা হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। তিনি প্রস্তাব করেন সামাজিক ব্যবসা তহবিল, কৃষি উদ্ভাবন কেন্দ্র, এবং জলবায়ু-স্মার্ট উদ্যোগে তরুণদের সম্পৃক্ত করার। “যদি আমরা তরুণদের বিনিয়োগ করি, আমরা শুধু পৃথিবীকে খাওয়াবো না—আমরা পৃথিবী বদলে দেবো।”
বিশ্ব ঐক্যের ডাক
ভাষণের শেষাংশে প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ গর্বিত যে আমরা ‘Global Alliance Against Hunger and Poverty’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এফএও ও জি২০-এর সঙ্গে আমরা বাস্তব, প্রযুক্তিগত ও নৈতিক সহযোগিতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, আজকের বিশ্বে সম্পদ ও প্রযুক্তি আছে। এখন প্রয়োজন কল্পনা, সৃজনশীলতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। “আমরা যদি কল্পনা করতে পারি, তবে আমরা তা গড়তেও পারি।” ভাষণের শেষে শ্রোতারা দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন জানান।
বস্টন বাংলা: সম্প্রীতি সমৃদ্ধির যোগসূত্র।
আপনার বিজ্ঞাপন এখানে