82°F বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মেনু

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ: মহাশক্তিদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা।

Online Desk, Boston Bangla

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫ | নিউজটি দেখেছেন: ২৪৪
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ: মহাশক্তিদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ: মহাশক্তিদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ কৌশলগত অঙ্গনে পরিণত হওয়ায় বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে একটি সঙ্কটাপন্ন অবস্থানে রয়েছে। ভারতের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, চীনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ এবং আমেরিকার সামরিক প্রভাবের মধ্যে অবস্থান করে ঢাকা’কে এমন কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যা আগামী দশকগুলোর জন্য দেশের সার্বভৌমত্ব নির্ধারণ করবে। এশিয়া জুড়ে ঐতিহাসিক নজির দেখায় যে, মহাশক্তিদের সাথে সম্পর্কে ভুল পদক্ষেপ অপরিবর্তনীয় পরিণতি বয়ে আনতে পারে—এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

ভারতীয় ধাঁধা: অংশীদার থেকে পৃষ্ঠপোষকে?

১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে ভারতের আধিপত্য একটি অনিবার্য বাস্তবতা। হাসিনা যুগে (২০০৯-২০২৪) এই প্রবণতা বিশেষভাবে দৃশ্যমান, যেখানে নয়া দিল্লি:

  • অনিয়ম এর অভিযোগ সত্ত্বেও নির্বাচনী ফলাফলে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) 

  • বাংলাদেশের ৯৮% ট্রানজিট ভারতের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছে I

  • চীন-সমর্থিত তিস্তা নদী প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পে বাধা দিয়েছে I

QUAD ফ্যাক্টর:
মার্কিন-নেতৃত্বাধীন জোট (QUAD, I2U2) এ ভারতের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি তার আঞ্চলিক ভূমিকাকে রূপান্তরিত করছে। সাবেক ভারতীয় নৌপ্রধান অ্যাডমিরাল করমবীর সিংয়ের ভাষায়, "বঙ্গোপসাগর আমাদের বাড়ির উঠোন"—এমন একটি মতামত যা সরাসরি বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনকে প্রভাবিত করে।

কেস স্টাডি: নেপালের শিক্ষা
২০১৭ সালে কাঠমান্ডু যখন চীনের BRI-এর মাধ্যমে অংশীদারিত্বে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছিল, ভারত একটি অঘোষিত অবরোধ আরোপের মাধ্যমে নেপালের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছিল—এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা।

আমেরিকান কৌশল: বঙ্গোপসাগরে ট্রোজান হর্স?

মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (২০২২) স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের সাথে "স্থায়ী অংশীদারিত্ব" চায়, বিশেষত:

  • নৌ অ্যাক্সেস: সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপ ও কক্সবাজারে মার্কিন আগ্রহ দিয়েগো গারসিয়া'র মতোই, যেখানে ব্রিটেনের ১৯৬৬ সালের লিজ স্থানীয়দের উচ্ছেদ করে একটি স্থায়ী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল।

  • অর্থনৈতিক লিভারেজ: প্রস্তাবিত IPEF ডিজিটাল গভর্নেন্স ও শ্রম সংস্কারের উপর কঠোর শর্ত আরোপ।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ফিলিপাইনের বেস চুক্তি
১৯৪৭ সালের মার্কিন-ফিলিপাইনস সামরিক ঘাঁটি চুক্তি প্রথমে উপকারী মনে হলেও, ১৯৯১ সালে ফিলিপাইনকে আমেরিকান বাহিনী সরানোর জন্য একটি তিক্ত রাজনৈতিক লড়াই করতে হয়েছিল—এমন একটি প্রক্রিয়া যা বর্তমান উত্তপ্ত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিলিপি করা কঠিন হবে।

চীনা বিকল্প: সুযোগ ও বাস্তবতা I

 পশ্চিমা মডেল থেকে চীনের পদ্ধতি মৌলিকভাবে আলাদা, যেমনটি দেখা যায়:

১. অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার:

  • BRI বিনিয়োগ (বাংলাদেশে $৩৮ বিলিয়ন) রাজনৈতিক শর্তারোপের পরিবর্তে পদ্মা সেতু, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো শক্ত অবকাঠামোর উপর মনোযোগ নিবদ্ধ করে।

  • Yuan-ভিত্তিক বাণিজ্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে যেতে সাহায্য করে (রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ)।

২. কৌশলগত অংশীদারিত্ব:

  • পাকিস্তানের JF-১৭ যুদ্ধবিমান (চীনে নকশাকৃত) ও নৌ আধুনিকীকরণ সামরিক সুবিধা প্রদর্শন করে।

  • ইরানের সাথে ২৫ বছরের চুক্তি (২০২১) দেখায় যে চীন তার অংশীদারদের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে প্রস্তুত।

রাশিয়া ফ্যাক্টর:
মস্কোর Rosatom বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে—এমন একটি প্রকল্প যা শক্তি স্বাধীনতা দিতে পারে এবং এখনো মার্কিন CAATSA নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েনি, যা ঢাকার কূটনৈতিক দক্ষতার পরীক্ষা নিচ্ছে।

বাংলাদেশের জন্য নীতি সুপারিশ

১. ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল:

  • চীনের অবকাঠামো অর্থায়ন গ্রহণ করার পাশাপাশি মার্কিন নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বজায় রাখা

  • চীনের Global Security Initiative (GSI)-এ যোগদান (সামরিক চুক্তি ছাড়াই প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি অর্জনের জন্য)

২. আইনি সুরক্ষা:

  • নৌ চুক্তি মালয়েশিয়ার মডেলে করা: স্বল্পমেয়াদী, নবায়নযোগ্য অনুমতি যেখানে বিদেশী ঘাঁটি স্থায়ী হবে না তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে I

  • বিদেশী ঘাঁটি নিষিদ্ধ করতে সংবিধান সংশোধন (শ্রীলঙ্কার ২০১৯ MCC প্রতিরোধের মতো)

৩. আঞ্চলিক জোট গঠন:

  • BIMSTEC-কে পুনরুজ্জীবিত করা (ভারতীয় আধিপত্য ভারসাম্যের বিপরীত করার জন্য একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে)

  • মিয়ানমারের সাথে শক্তি অংশীদারিত্ব (পশ্চিমা আপত্তি সত্ত্বেও) যাতে ভারত-নির্ভর সরবরাহ শৃঙ্খল হ্রাস পায় I

সার্বভৌমত্বের অপরিহার্যতা :

ক্লায়েন্ট স্টেট হয়ে ২০৩১ সালের উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। নিম্নলিখিত উদাহরণগুলো প্রমাণ করে:

  • শ্রীলঙ্কা (ঋণ-ফাঁদ কূটনীতির আখ্যান)

  • পাকিস্তান (আফগানিস্তান পরবর্তী মার্কিন পরিত্যাগ)

  • ভিয়েতনাম (সফল multi-alignment)

কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য বেদনাদায়ক কিন্তু প্রয়োজনীয় সমঝোতা প্রয়োজন। যদিও চীন ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রতি-ওজন হিসেবে কাজ করবে , তবুও ঢাকা’কে অবশ্যই:

  • আঞ্চলিক অ্যাক্সেসে একটি লাল রেখা স্থির করতে হবে I

  • অর্থনৈতিক অংশীদারদের মধ্যে বৈচিত্র আনতে হবে I (GCC, ASEAN বাজার বিবেচনা করুন)

  • স্থানীয় প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বিনিয়োগ করতে হবে I

চলতি ৫-১০ বছর নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ একটি ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে নাকি New Cold War-এ একটি সত্যিকার স্বাধীন ক্রীড়নক হিসেবে আবির্ভূত হবে। বাংলাদেশকে কারো দাবাখেলার ঘুঁটি হতে দেওয়া যাবে না—এটি এখনই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।


লেখকঃ আজাদ খান, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সরকার।