77°F রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মেনু

মৃতের লাশ জিম্মি করে টাকা আদায়: এটি কেবল অমানবিক নয়, একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ

বস্টন বাংলা, Boston Bangla

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টে ২০২৫ | নিউজটি দেখেছেন: ৩২
মৃতের লাশ জিম্মি করে টাকা আদায়: এটি কেবল অমানবিক নয়, একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ

মৃতের লাশ জিম্মি করে টাকা আদায়: এটি কেবল অমানবিক নয়, একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ

আজাদ খান

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটি আমাদের সমাজের গভীর নৈতিক অবক্ষয়ের এক করুণ দৃষ্টান্ত। একজন মৃত রাজমিস্ত্রি হারুন মিয়ার লাশ দাফনের আগে সুদের টাকা পরিশোধের দাবিতে যে বাধা দেওয়া হয়েছে, তা কেবল অমানবিকতাই নয়, এটি আইনের চোখেও একটি গুরুতর অপরাধ। এই ধরনের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও বাড়তে পারে, যা সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই ঘটনা কেবল নৈতিকভাবে নিন্দনীয় নয়, এটি চাঁদাবাজির মতো একটি ফৌজদারি অপরাধও বটে।

আইনি বিশ্লেষণ: একটি গুরুতর অপরাধের স্পষ্ট উদাহরণ

আইন অনুযায়ী, কোনো পাওনাদার তার পাওনা আদায়ের জন্য আইনি পথ অবলম্বন করতে পারেন। কিন্তু মৃত ব্যক্তির প্রতি এমন অসম্মানজনক আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি সরাসরি ফৌজদারি অপরাধের আওতায় পড়ে।

  • যদি ঋণ অবৈধ বা বিতর্কিত হয়: যদি ঋণদাতার সুদের দাবি করার কোনো আইনি ভিত্তি না থাকে—যেমন ঋণ আগেই পরিশোধ করা হলে, সুদের হার ইসলামি বা দেওয়ানি আইন অনুযায়ী অতিরিক্ত বা অবৈধ হলে, অথবা দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা হলে—এটি চাঁদাবাজির একটি সুস্পষ্ট ঘটনা। অপরাধী মৃতদেহ অপবিত্র করার হুমকি দিয়ে এমন অর্থ আদায় করছে, যার ওপর তার কোনো বৈধ অধিকার নেই।
  • লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা: বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, টাকা ধার দেওয়া এবং সুদ আদায়ের জন্য যথাযথ লাইসেন্স প্রয়োজন। শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত বৈধ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই ধরনের কার্যকলাপে জড়িত হতে পারে। লাইসেন্সবিহীন ঋণদান নিজেই একটি পৃথক ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে।
  • অবৈধ আদায় পদ্ধতি: এমনকি যদি কোনো বৈধ ঋণও থাকে, কোনো পাওনাদারের তা আদায়ের জন্য অবৈধ বা বলপ্রয়োগের পদ্ধতি ব্যবহার করার অধিকার নেই। পাওনাদারদের অবশ্যই আইনি পথ অনুসরণ করতে হবে, যেমন মামলা দায়ের করা, আদালতের রায় বা আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা করা।
  • হুমকির ফৌজদারি প্রকৃতি: একজন মৃত ব্যক্তির লাশ "জিম্মি" করে রাখা ঋণ আদায়ের একটি অগ্রহণযোগ্য ও অবৈধ পদ্ধতি, যা ফৌজদারি আইন এবং মৌলিক মানব মর্যাদাকে লঙ্ঘন করে। কোনো ঋণ বৈধ হোক বা না হোক, সঠিক দাফন কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার এই কাজটি একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ, যার বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।

দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা জরুরি

এই ঘটনা প্রমাণ করে, আমাদের সমাজে আইনের প্রয়োগের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। নাটোরে একটি মৃতদেহ কবর থেকে তুলে জনসমক্ষে পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনার সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যা সমাজে অপরাধপ্রবণতার গভীরতা তুলে ধরে।

এই বর্বর প্রথার বিস্তার ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। পুলিশকে শুধু খোঁজখবর নিয়েই ক্ষান্ত হলে চলবে না, ভুক্তভোগী পরিবারকে মামলা করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ধরনের অপরাধকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিলে তা আমাদের সমাজের মানবিক মূল্যবোধ ও আইনি কাঠামোকে দুর্বল করে দেবে।

মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান রক্ষা করা শুধু ধর্মেরই শিক্ষা নয়, এটি একটি সভ্য সমাজের মৌলিক ভিত্তি। যখন মৃতদেহকেও জিম্মি করে অবৈধ অর্থ আদায় করা হয়, তখন তা সমগ্র সমাজের প্রতি একটি সতর্কবার্তা। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর আইনি পদক্ষেপ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক প্রতিরোধের বিকল্প নেই।

লেখকঃ আজাদ খান, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।