70°F শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মেনু

হাসি দিয়ে আমেরিকা জয়: বিশ্বের রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্কের নতুন মেয়র জোহরান মামদানীর গল্প

Rokon Pathan, Boston Bangla

প্রকাশ: ০৫ নভে ২০২৫ | নিউজটি দেখেছেন: ১১
হাসি দিয়ে আমেরিকা জয়: বিশ্বের রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্কের নতুন মেয়র জোহরান মামদানীর গল্প

নিউইয়র্কের নভেম্বরের রাত। কুইন্সের রাস্তায় তখনও ঢোলের শব্দ, মানুষ নাচছে, কেউ চিৎকার করে বলছে—We did it!

এই উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রে এক তরুণ নেতা, নাম জোহরান মামদানি। তাঁর মুখে এক মৃদু হাসি যেন ক্লান্ত নয়, বরং স্বপ্নপূরণের এক শান্ত তৃপ্তি।

হাজারো মুখের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন আমেরিকার প্রতিচ্ছবি। এমন এক আমেরিকা যেখানে শিকড় আফ্রিকায়, শিক্ষা ব্রুকলিনে, উচ্চারণে হালকা প্রবাসের টান আর রাজনীতির মঞ্চে উঠে এসেছে এক সাহসী কণ্ঠ।

মামদানি জন্মেছেন উগান্ডায়, শৈশবে পরিবারসহ কানাডা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। তাঁর বাবা মশহুর সমাজবিজ্ঞানী মাহমুদ মামদানি, মা লেখক মিরিয়াম। কিন্তু জোহরান নিজের পথ আলাদা করলেন তিনি রাজনীতি বেছে নিলেন, সেই নিউইয়র্কে যেখানে জাতি, ধর্ম, ভাষা আর অভিবাসন-রাজনীতির সীমানা সবসময়ই কাঁপতে থাকে।

একজন মুসলিম অভিবাসী, আফ্রিকান-উৎপত্তি, দক্ষিণ এশীয় বংশধর সবমিলিয়ে এক বহুগুণিত জটিল পরিচয়। কিন্তু তিনি এটিকে বাঁধা হিসেবে দেখেননি।

তিনি এটিকে করেছেন নিজের “মানুষের ভাষা” যেখানে আমেরিকার প্রতিটি নাগরিককে সমান মর্যাদায় যুক্ত করা যায়।

নিউইয়র্ক রাজনীতির ইতিহাসে অনেক প্রগতিশীল মুখ এসেছে, কিন্তু মামদানীর মতো প্রাণবন্ত, সোজাসাপ্টা এবং যুব-কণ্ঠস্বর খুব কম।তিনি বলেছিলেন—

আমরা যাদের বাড়ি ভাড়ার চিন্তা আছে, যাদের চিকিৎসার বিল দিতে হয়, যাদের নাম অচেনা, তবুও আমরাই নিউইয়র্ক।

এই এক বাক্যেই তিনি লাখো সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জিতে নিয়েছিলেন।তাঁর প্রচারণা অফিসে কেউ ছিল না বড় কর্পোরেট দাতা, কেউ ছিল না রাজনৈতিক অভিজাত। ছিলেন কর্মী, অভিবাসী, রাইডশেয়ার ড্রাইভার, কলেজ-ছাত্র, আর বৃদ্ধ দম্পতি যাদের বিশ্বাস ছিল, রাজনীতি বদলাতে পারে, যদি তা সত্যিকারের মানুষকেন্দ্রিক হয়।

এই নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এক সময়ের ক্ষমতাশালী গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো।রাজনীতির মঞ্চে নাম, টাকা, প্রভাব সব ছিল কুওমোর দিকে। কিন্তু ভোটারদের হৃদয়ে প্রবল হাওয়া বইছিল অন্যদিকে।জোহরান বলেছিলেন, আমেরিকার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমরা কাকে ‘আপনজন’ হিসেবে দেখি তার ওপর।

এই উক্তিই যেন ভোটারদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল এক ধরনের সাহস।

জোহরান প্রচারণার সময় প্রায়ই হাসতেন সেই উষ্ণ, সহজ, মানবিক হাসি।তিনি জানতেন, ক্রোধের রাজনীতিতে মানুষ ক্লান্ত।হাসিই এখানে তাঁর রাজনৈতিক অস্ত্র এক ধরনের নরম বিদ্রোহ, যা বলে, “আমরা ক্ষুব্ধ, কিন্তু আমরা এখনও আশাবাদী।”

এক স্থানীয় সংবাদমাধ্যম লিখেছিল,

Mamdani didn’t just win votes. He won hearts—with that calm, confident smile that felt like home.

এই হাসি হয়তোই ‘আমেরিকা জয়’-এর প্রতীক হয়ে উঠেছে একটা মুখ, যেটি বোঝায় আশা, মিলন, আর পুনর্জন্ম।

নিউইয়র্ক এমনই এক শহর যেখানে ব্রঙ্কসের কফিশপ, কুইন্সের বাজার আর ব্রুকলিনের পার্ক সব জায়গায় পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা বাজে।জোহরান সেখানে নতুন অর্থে দাঁড়ালেন তিনি হয়ে উঠলেন সেই শহরের আত্মা।তার প্রচারণার ব্যানারে দেখা যেত উর্দু, আরবি, বাংলা, স্প্যানিশ, হিব্রু সব ভাষার টুকরো মিলিয়ে লেখা এক বড় শব্দ: Home. এ যেন আমেরিকার নতুন সংজ্ঞা জাতিগত নয়, মানবিক সংহতিতে গড়া এক নাগরিক-পরিচয়।

জোহরান মামদানি শুধু নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জিতেননি; তিনি জিতেছেন অর্থবহ প্রতিনিধিত্বের রাজনীতি।তাঁর জয়ের মধ্য দিয়ে যে বার্তাটি ছড়িয়ে গেছে তা হলো তুমি যদি নিজেকে অবহেলিত ভাবো, মনে রেখো, রাজনীতির মঞ্চ তোমারও হতে পারে।

প্রবাসী বাঙালিদের জন্যও এই বার্তাটি গভীর। কারণ অভিবাসী জীবনের প্রতিটি ধাপে যে সংগ্রাম, সেটাই তো তাকে তৈরি করে এক নতুন নাগরিক হিসেবে। জোহরান যেন সেই অভিজ্ঞতারই প্রতীক।

রাজনীতি এখানে শেষ হয়নি এখনই শুরু।

তাঁর সামনে রয়েছে গৃহনির্মাণ-সংকট, জননিরাপত্তা, জলবায়ু নীতি, ও শহরের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের মতো জটিল চ্যালেঞ্জ।কিন্তু তিনি যেমন বলেছেন—

Change isn’t an event. It’s a journey we take together.

এই বাক্যটিই যেন তাঁর পুরো দর্শন সংঘাত নয়, সহযোগিতা; বিভাজন নয়, সংলাপ।

আজকের আমেরিকা বিভক্ত, ভয়-পাওয়া, ক্লান্ত। কিন্তু জোহরান মামদানি সেখানে এক নতুন দৃশ্য এঁকেছেন—

এক রাজনীতিক, যিনি তর্কে নয়, হাসিতে বিশ্বাস করেন।

এক নাগরিক, যিনি পরিচয়ে নয়, সহমর্মিতায় নিজের পরিচয় খুঁজে পান।এবং এক প্রজন্ম, যারা বুঝতে শিখছে পরিবর্তন শুধু সম্ভব নয়, আনন্দময়ও হতে পারে।

আমেরিকা সবসময়ই গল্পের দেশ। কিন্তু এই গল্পটি একটু আলাদা।এখানে রাজনীতি এসেছে কবিতার মতো, হাসি এসেছে বিপ্লবের মতো, আর জয় এসেছে নীরব এক বিশ্বাস থেকে।জোহরান মামদানি আমাদের মনে করিয়ে দিলেন হাসি দিয়েও আমেরিকা জয় করা যায়।

লেখক: রোকন পাঠান, email: pathanpti@gmail.com