মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা, প্রযুক্তি বিশ্বের কিংবদন্তি, আর এখন মানবকল্যাণমূলক কাজের প্রতীক — বিল গেটস। জীবনের প্রতিটি ধাপে তিনি পেয়েছেন এমন কিছু মানুষকে, যাদের শিক্ষা, প্রেরণা ও দিকনির্দেশনা তাঁকে গড়ে তুলেছে আজকের বিল গেটস হিসেবে।
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে নিজের ব্লগ GatesNotes-এ তিনি লিখেছেন সেই ছয়জন অসাধারণ শিক্ষকের গল্প, যারা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিলেন।
গেটস লিখেছেন, “আমি ভাগ্যবান, কারণ এমন পরিবারে জন্মেছি যারা সবসময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। এমন স্কুলে পড়েছি যেখানে কম্পিউটারের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ছিল। কিন্তু এর চেয়েও বড় সৌভাগ্য — সেই শিক্ষকেরা, যারা আমার ভেতরের কৌতূহলটা চিনতে পেরেছিলেন।”
তিনি বলেন, প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত তাঁর শিক্ষকেরা কখনো তাঁকে শুধু ছাত্র হিসেবে নয়, বরং একজন চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে দেখেছেন। “তাঁরা বক্তৃতা দিয়ে শেখাননি, বরং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার সুযোগ দিয়েছিলেন,” লিখেছেন গেটস।
প্রথম শ্রেণি থেকেই গেটসের জীবনে আসা ব্লানশ ক্যাফিয়েরি ছিলেন তাঁর কাছে এক আশীর্বাদ। অন্য শিক্ষকরা যখন তাঁকে দুষ্টুমি করা এক ‘সমস্যা’ হিসেবে দেখতেন, তখন ক্যাফিয়েরি ম্যাডাম দেখেছিলেন তার মধ্যকার ‘সমাধান খোঁজার মানসিকতা’।
লাইব্রেরির হারিয়ে যাওয়া বইগুলো খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়ে তিনি গেটসের দায়িত্ববোধ ও অনুসন্ধানী মনকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
গেটস বলেন, “আমি ভাবতাম আমি তাঁকে সাহায্য করছি, কিন্তু আসলে তিনি আমাকে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সুযোগ দিচ্ছিলেন।”
অষ্টম শ্রেণির গণিত শিক্ষক পল স্টকলিন ছিলেন সেই মানুষ, যিনি প্রথম গেটসকে কম্পিউটারের জগতে পরিচয় করিয়ে দেন।
একদিন পুরো ক্লাসকে নিয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন টেলিটাইপ মেশিন — ক্যালিফোর্নিয়ার এক কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত সেই মেশিনেই গেটস প্রথম প্রোগ্রামিংয়ের স্বাদ পান।
সেই মুহূর্তটিই তাঁর জীবনের বাঁক বদল। এখানেই তাঁর দেখা হয় বন্ধু কেন্ট ইভান্স-এর সঙ্গে, যিনি পরবর্তীতে গেটসের প্রথম ব্যবসায়িক অংশীদার হন।
লেকসাইড স্কুলের গণিত বিভাগের প্রধান বিল ডগল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেভি পাইলট ছিলেন। কম্পিউটার তখন ছিল বিলাসিতা, তবু তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে প্রোগ্রামিংয়ের সুযোগ এনে দেন।
গেটস বলেন, “তিনি নিজে প্রোগ্রামার ছিলেন না, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন ভবিষ্যৎ এই প্রযুক্তির ওপরই দাঁড়াবে।”
ডগল স্যারের আউটডোর ক্যাম্পিং ক্লাস গেটসকে শিখিয়েছিল টিমওয়ার্ক, ধৈর্য আর সমস্যা সমাধানের প্রকৃত মানে।
কম্পিউটার শিক্ষক ফ্রেড রাইট কোনো নিয়মের কাঠামোতে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর ক্লাসে ছিল না তালাবদ্ধ ল্যাব বা উপস্থিতি শিট।
তিনি শিক্ষার্থীদের বলতেন, “শেখার সেরা উপায় হলো নিজে ভুল করা, আর সেটা থেকে শিক্ষা নেওয়া।”
এই স্বাধীনতার মধ্যেই গেটস নিজের প্রোগ্রামিং দক্ষতা গড়ে তুলেছিলেন — যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে মাইক্রোসফটের ভিত্তি।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডিধারী ড. ড্যানিয়েল মরিস ছিলেন রসায়ন শিক্ষক। তিনি ল্যাব কোট পরে বিকারে কফি খেতেন, আর বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো বোঝাতেন দৈনন্দিন উদাহরণে।
গেটস বলেন, “তাঁর কাছেই প্রথম বুঝেছিলাম বিজ্ঞান কোনো মুখস্থ বিষয় নয়, এটা বোঝার, প্রশ্ন করার এবং প্রয়োগের ব্যাপার।”
তাঁর অনুপ্রেরণাতেই গেটস হার্ভার্ডে অর্গানিক কেমিস্ট্রি পড়েছিলেন — যদিও মজা করে লিখেছেন, “ওই কোর্সে আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ গ্রেডটা পেয়েছিলাম!”
হার্ভার্ডের অধ্যাপক টম চিথাম ছিলেন সেই মানুষ, যিনি গেটসকে ‘বিশ্বাস’ উপহার দিয়েছিলেন।
তিনি গেটসকে পিডিপি-১০ কম্পিউটারে কাজ করার অনুমতি দিয়েছিলেন, যদিও সাধারণত সেটা শুধু গবেষক ও অধ্যাপকদের জন্য বরাদ্দ ছিল।
“তিনি আমার মধ্যে কিছু দেখেছিলেন— হয়তো কৌতূহল, হয়তো সম্ভাবনা। যা-ই হোক, সেই বিশ্বাসই আমাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে,” লিখেছেন গেটস।
গেটস স্বীকার করেছেন, “হয়তো আমি কোনো দিন তাঁদের যথেষ্ট ধন্যবাদ জানাতে পারিনি। কিন্তু তাঁদের কারণেই আমি বুঝেছি— একজন অনুপ্রেরণাদায়ী শিক্ষক কেবল জ্ঞান দেন না, তিনি ভবিষ্যৎ গড়ে দেন।”
সংক্ষেপে:
বিল গেটসের জীবনের প্রতিটি বড় সাফল্যের পেছনে ছিল এই ছয়জন শিক্ষক—যাঁরা তাঁকে চিন্তাশীল, আত্মবিশ্বাসী এবং উদ্ভাবনী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
শিক্ষক দিবসে তাঁদের প্রতি বিল গেটসের এই শ্রদ্ধা প্রমাণ করে— সত্যিকারের শিক্ষা কেবল বইয়ের পাতায় নয়, বরং মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে চিনে তোলার মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
আপনার বিজ্ঞাপন এখানে