79°F বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মেনু

সম্মান, সমীহ ও পরমাণু অস্ত্র – বিশ্বের নতুন ভাষা?

Rokon Pathan, Boston Bangla

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | নিউজটি দেখেছেন: ৭
সম্মান, সমীহ ও পরমাণু অস্ত্র – বিশ্বের নতুন ভাষা?

সম্মান, সমীহ ও পরমাণু অস্ত্র – বিশ্বের নতুন ভাষা?

বিশ্ব কূটনীতিতে সম্প্রতি এক অভূতপূর্ব সংকেত লক্ষ করা গেছে—যে রাষ্ট্রের হাতে পরমাণু অস্ত্র আছে, সে রাষ্ট্রের প্রতি বাড়ছে সম্মান ও সমীহ; অন্যদিকে দুর্বল বা নিরস্ত্র রাষ্ট্রেরা ক্রমাগত অবমাননার শিকার হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনীরকে অভ্যর্থনা ও নৈশভোজে নিমন্ত্রণ, অথচ গণতান্ত্রিক বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য অপেক্ষাকৃত শীতল কূটনৈতিক বার্তা—একটি শক্তিশালী প্রতীকী বার্তা বহন করে। এটি যেন বলছে, "পরমাণু অস্ত্রধারী হলে তবেই তুমি শ্রদ্ধার যোগ্য।"


 অস্ত্রের বদলে মর্যাদা?

১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের পরমাণু পরীক্ষার পর থেকে দেশটি আন্তর্জাতিক মহলে এক ধরনের 'immunity' অর্জন করে। যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতান্ত্রিক ব্যত্যয় এবং জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, তথাপি তাদের সামরিক ও পরমাণু সক্ষমতা বড় শক্তিগুলোর কাছে একটি "ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর" হিসেবে বিবেচিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস একবার বলেছিলেন:

“You don’t want Pakistan to fail—it’s a nuclear-armed state. Stability outweighs ideology.”

এই দৃষ্টিভঙ্গি ইঙ্গিত দেয়—পরমাণু অস্ত্রধারী দেশগুলোর ‘stability’ রক্ষাই এখন বড় উদ্দেশ্য, এমনকি গণতন্ত্র বা মানবাধিকার ছাড় দিয়ে হলেও।


 ইরান: পরমাণুহীন বলেই কি অরক্ষিত?

২০১৫ সালের JCPOA চুক্তি অনুসারে ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম সীমিত রাখে। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এরপর থেকেই ইরান আরব দেশগুলোর সঙ্গে শত্রুতা, ইসরায়েলি হামলা, অর্থনৈতিক অবরোধ এবং হত্যাকাণ্ড (যেমন কাসেম সোলাইমানির ড্রোন হামলা) ইত্যাদির শিকার।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন:

“Had we possessed the deterrent strength of our adversaries, we wouldn’t be bombed. That’s the cruel truth.”

এই স্বীকারোক্তি কেবল ইরানের নয়, অনেক রাষ্ট্রের শঙ্কা ও প্রতিক্রিয়া—পরমাণু অস্ত্র না থাকলে আপনি নিঃসঙ্গ।


 সৌদি-ইরান শান্তি চুক্তি: অস্ত্র নয়, সমঝোতার উদাহরণ

২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইরান একটি ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি করে। মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এটি ছিল এক বিরল কূটনৈতিক সাফল্য। এই চুক্তি দেখিয়েছে—সম্মান বা নিরাপত্তা অর্জনের জন্য পরমাণু নয়, দরকার পারস্পরিক স্বীকৃতি ও সংলাপ।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন:

“Conflict is not destiny. Dialogue can replace deterrence.”

এই বার্তা ছিল বিপরীত ধারার—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক ভদ্রতা বিসর্জন দিয়ে "পরমাণুর প্রতি সমীহ" প্রদর্শন করছে, সেখানে চীন "সমঝোতা"কে সামনে এনে একটি বড় শক্তির ভূমিকা নিচ্ছে।


উত্তর কোরিয়া: এক পরমাণু বোমা, এক ছায়া-সম্মান

উত্তর কোরিয়ার দৃষ্টান্ত আরো চমকপ্রদ। দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়নমূলক ও বন্ধ রাষ্ট্রগুলোর একটি, তবু যুক্তরাষ্ট্র এমনকি দক্ষিণ কোরিয়াও এখন সরাসরি হামলার পরিবর্তে 'ডেটারেন্স' রক্ষায় আগ্রহী।
২০১৮-২০১৯ সালে কিম জং উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে তিনবার বৈঠক হয়েছে—যেটা কল্পনাও করা যেত না যদি উত্তর কোরিয়ার হাতে পরমাণু অস্ত্র না থাকত।

ট্রাম্প নিজেই বলেছিলেন (2019):

“He’s got nukes, so we need to talk.”

এই বক্তব্য বর্তমান বিশ্ববাস্তবতার নির্মম অথচ স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।


পরমাণু অস্ত্র বনাম নৈতিকতা: কোন পথে যাবে বিশ্ব?

এই মুহূর্তে একটি ভয়াবহ প্রশ্ন সামনে এসেছে:
আন্তর্জাতিক সম্মান কি কেবল অস্ত্রে অর্জিত হবে? নাকি মানবতা, সংলাপ ও উন্নয়ন হবে মর্যাদার মানদণ্ড?

আজকে যদি ইরান, সৌদি, বাংলাদেশ কিংবা কোনো আফ্রিকান রাষ্ট্র নিজেদের রক্ষা করতে চায়, তাহলে তারা কী করবে? কূটনীতি? উন্নয়ন? না কি গোপনে পরমাণু কর্মসূচি?

এই প্রশ্নের জবাব নির্ভর করছে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর নীতি ও বার্তার উপর। যদি বড় রাষ্ট্রগুলো পরমাণু অস্ত্রের ধারকদেরই কেবল কূটনৈতিক সমীহ দেখায়, তবে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য বিকল্প কোনো পথই থাকবে না।


উপসংহার: একটি নৈতিক আহ্বান

পরমাণু নয়, নৈতিকতা হোক সম্মানের মানদণ্ড।
সম্মান কেবল শক্তির নয়, মানবিকতাও হতে পারে। বড় রাষ্ট্রগুলোর উচিত তাদের আচরণে সেটি প্রমাণ করা—নইলে আগামী দশকে বিশ্বজুড়ে আমরা নতুন এক পরমাণু দৌড় দেখবো, যেখানে ক্ষমতার ভাষা হবে বিস্ফোরণ, আর ন্যায় থাকবে নিঃশব্দে।