82°F বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মেনু

অমরত্ব পেলেন জ্ঞানব্রতী যতীন সরকার

Online Desk, Boston Bangla

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৫ | নিউজটি দেখেছেন: ৪
অমরত্ব পেলেন জ্ঞানব্রতী যতীন সরকার

শুভ জন্মদিন আত্মার আত্মীয়... 
অমরত্বের স্বাদ সকলেই পায় না, যাঁরা পায় তাঁরাই প্রকৃত মানুষ, মানবের মধ্যে উত্তম।

বাংলাদেশের প্রগতিশীল চেতনার আকাশে অধ্যাপক যতীন সরকারের নাম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কেবল শিক্ষক নন; ছিলেন একাধারে মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাংস্কৃতিক কর্মী,  নির্ভীক ও মানবতার অটল সাধক। তাঁর চিন্তা, কর্ম ও লেখনী সবসময় সমান প্রাসঙ্গিক।
অধ্যাপক যতীন সরকার জীবনভর তিনি মানবমুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রগতিশীল চিন্তার পথে নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর লেখনী যেমন ছিল তীক্ষ্ণ ও যুক্তিনির্ভর, তেমনি প্রাণস্পর্শী ও মানবমুখী। শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে তিনি দেখতেন মানুষের মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে, আর সাহিত্যকে মানতেন মনন ও সমাজ বদলের শক্তি হিসেবে। গ্রামীণ জীবন থেকে শহরের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন- সবখানেই তিনি জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর জীবনদর্শন ছিল মানুষের সাথে মানুষের মেলবন্ধন ঘটানো, বৈষম্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম ও কণ্ঠ সমানভাবে চালানো। তাই তাঁর প্রয়াণ শুধু একজন মানুষের বিদায় নয়, বরং এক দীর্ঘ আলোকযাত্রার পরিসমাপ্তি।

১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামে জন্ম নেন তিনি।  গ্রামীণ জীবনের সরলতা ও সংগ্রাম ছিল তাঁর প্রথম পাঠশালা। শৈশব থেকেই তিনি শিক্ষার প্রতি নিবেদিত ছিলেন, আর সেই শিক্ষাজীবনের পরিণত রূপ তিনি খুঁজে পান শিক্ষকতায়। ১৯৬৪ খ্রি. থেকে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপনা শুরু করে প্রায় চার দশক ধরে তিনি জ্ঞানের আলো বিলিয়েছেন। 

যতীন সরকারের বৌদ্ধিক ভিত্তি ছিল মার্কসবাদে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। তিনি বিশ্বাস করতেন- সমাজের মৌলিক পরিবর্তন সম্ভব কেবল বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে। তাঁর বক্তব্যে ও লেখায় সর্বদা উঠে এসেছে শ্রেণি-সংগ্রাম, সাম্যবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজনীয়তা। তাঁর দৃষ্টিতে মার্কসবাদ ছিল গতিশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার দর্শন- যেখানে পরিবর্তনই একমাত্র স্থায়ী সত্য। তিনি সারাজীবন ছিলেন এক অবিচল মার্কসবাদী চিন্তাবিদ, যিনি সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতিকে দেখতেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁর কাছে মার্কসবাদ কেবল একটি রাজনৈতিক মতবাদ ছিল না, বরং জীবনযাপনের নৈতিক ও বৌদ্ধিক দিকনির্দেশনা। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মুক্তি সম্ভব কেবল শ্রেণিবৈষম্যের অবসান এবং উৎপাদনের উপকরণের উপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই কারণে তিনি সবসময় পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব থেকেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন নির্ভীক সমালোচক- ক্ষমতার পালাবদল নির্বিশেষে যে কোনো দমননীতি, দুর্নীতি ও অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি কণ্ঠ তুলেছেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা, সামাজিক বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় দমননীতি তাঁকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছিল, এবং এসব পরিবর্তনের জন্য তিনি রাজনৈতিক সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের সমান্তরাল আন্দোলনের ওপর জোর দেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকেও তিনি অন্ধ আনুগত্যে বিশ্বাস করতেন না; বরং যুক্তি ও নীতির ভিত্তিতে মতপ্রকাশ করতেন, যা তাঁকে রাজনৈতিকভাবে স্বতন্ত্র ও বৌদ্ধিকভাবে সম্মানিত করে তোলে। তাঁর মার্কসবাদী অবস্থান ছিল প্রগতিশীল মানবতাবাদের সাথে যুক্ত- যেখানে মানুষ, তার মর্যাদা ও মুক্তিই চূড়ান্ত লক্ষ্য।

যতীন সরকার ছিলেন এক গভীর মননশীল গবেষক। তাঁর রচনায় ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও দর্শনের মিশেল পাওয়া যায়। তাঁর সাহিত্যচর্চা ছিল সমাজ, ইতিহাস ও সংস্কৃতির গভীর উপলব্ধি থেকে উৎসারিত। তাইতো তিনি শেষ জীবনে এসে বলতে পেরেছেন "আমি জীবিত নেই, বেঁচে আছি"। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাহিত্য কেবল রসাস্বাদনের জন্য নয়, বরং মানুষের চেতনা জাগ্রত করার শক্তিশালী মাধ্যম। তাঁর লেখনী ছিল সহজবোধ্য অথচ চিন্তাপ্রবণ, যেখানে তথ্য, যুক্তি ও মানবিক সংবেদন একীভূত হয়ে পাঠককে ভাবনার নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিত। ইতিহাসের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমালোচনামূলক এবং বিশ্লেষণভিত্তিক; তিনি অতীতকে বিচার করতেন বর্তমানের বাস্তবতার আলোকে, এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ খুঁজে বের করতেন। তাঁর গবেষণায় লোকসংস্কৃতি, রাজনৈতিক ইতিহাস, ভাষা ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। প্রতিটি রচনায় তিনি পাঠকের কাছে একটি বৃহত্তর সামাজিক সত্য উন্মোচন করেছেন- যেখানে মানুষের সংগ্রাম, আশা ও সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এইভাবে তাঁর সাহিত্যকর্ম কেবল পাঠকের মনন সমৃদ্ধ করেনি, বরং প্রগতিশীল ও মানবিক সমাজ নির্মাণের আন্দোলনেও যুক্ত থেকেছে। তাঁর জীবনদর্শনের মূল ছিল মানবমুক্তি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। তিনি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখতেন। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে প্রগতিশীল চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন। কমিউনিস্ট পার্টিকে তিনি অন্তরে ধারণ করেছিলেন। তাঁর কাছে সাহিত্য-সংস্কৃতি ছিল মুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

লেখক হিসেবে যতীন সরকার তাঁর দীর্ঘ সাহিত্য ও গবেষণা জীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। ২০১০ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন; এর আগে ২০০৭ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০০৫ সালে পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন গ্রন্থের জন্য অর্জন করেছেন প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার। যদিও ছাত্রজীবনেই তাঁর লেখালেখি শুরু হয়েছিল, প্রথম গ্রন্থ সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে, যখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ বছর। এরপর তিনি ধারাবাহিকভাবে রচনা করেছেন অসংখ্য বই, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাংলাদেশের কবি গান, বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সংগ্রাম, গল্পে গল্পে ব্যাকরণ, ব্যাকরনের ভয় অকারণ, মানবমন মানব ধর্ম ও সমাজ বিপ্লব, পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন, পাকিস্তানের ভূত দর্শন, দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূতভবিষ্যৎ, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, ভাবনার মুক্তবাতায়ন প্রভৃতি। মোট অর্ধশতাধিক গ্রন্থের পাশাপাশি তিনি সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থও। তত্ত্বমূলক ত্রৈমাসিক পত্রিকা “সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র”-এর সম্পাদনার মাধ্যমেও তিনি দীর্ঘদিন জ্ঞানের জগতে অবদান রেখে গেছেন। প্রতিটি জাতীয় দিবসে তাঁর লেখা পাবার জন্য পত্রিকাগুলো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। 

যতীন সরকার নিজের জীবনকে তাঁর মননের সাথে একীভূত করেছিলেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তাই জীবনযাপনে অনুসরণ করতেন। সাধারণ জীবন, সাদামাটা পোশাক, বিনম্র আচরণ- সবই ছিল তাঁর নৈতিক দৃঢ়তার প্রতিফলন। তাঁর কাছে বুদ্ধিবৃত্তি ও মানবতা কখনো আলাদা ছিল না; বরং মানুষের মঙ্গলের জন্য জ্ঞানচর্চা ছিল তাঁর একান্ত সাধনা। তিনি যেমন ছিলেন অতি উচ্চমার্গের তেমনি ছিলেন অতি সাধারণ মানুষের প্রাণের এবং সকলকে তিনি অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সমাজভাবনা, জ্ঞান কিংবা চিন্ততার নতুনত্ব। একটি বিষয় বলতেই হয় ময়মনসিংহের মানুষ তার কাছে যতনা চেয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছে। কারণ যিনি দিতে জানেন তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন। যতীন সরকার দিয়েছেন সাহিত্যে শিল্প সংস্কৃতিকে যেমন তার লেখনীতে, তেমনি তার বক্তৃতায়। এমন প্রজ্ঞাপন পুরুষ ময়মনসিংহের মাটিতে দ্বিতীয়জন কবে আসবে তা বলা যায় না। আর আদৌ কি আসবেন! এক জীবনে তিনি যা দিয়ে গিয়েছেন, তা ধারণ করা কঠিন। তার হাসিটি ছিল অকৃত্রিম, আর তাতে প্রমাণ মেলে সরলতার, জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া একজন মানুষের। 

২০২৫ সালের ১৩ আগস্ট, প্রায় নব্বই বছর বয়সে, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি চলে গিয়েছেন। সাহিত্যের শূন্যতার এই সময়ে তাঁর মত একজনের কালদর্শীর চলে যাওয়া সাধারণ কোনো পতনে নয়, যেন নক্ষত্র খসে যাওয়া। তাঁর এই চিরপ্রস্থান এক রাজকীয় বিদায়- শিক্ষক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, জনসাধারণ- সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে এসেছিলেন। লাল পতাকা আর মানুষের ভালোবাসার বেষ্টনীতে তিনি যাত্রা করলেন চিরন্তনের পথে। অধ্যাপক যতীন সরকারের জীবন এক প্রেরণার বাতিঘর। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন- চিন্তা ও কর্ম যখন একীভূত হয়, তখন জীবন হয় মহিমান্বিত। তাঁর সাহিত্য, দর্শন, সাংস্কৃতিক অবদান ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার চিরকাল আমাদের পথ দেখাবে। তাই তাঁর জন্য সর্বোত্তম বিশেষণ একটাই- তিনি অমরত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন।