স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে আবারও পারমাণবিক উত্তেজনা ফিরে আসছে—এমন ইঙ্গিত মিলছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সাম্প্রতিক তীব্র বাকযুদ্ধ ও সামরিক প্রস্তুতি থেকে। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের হুমকির জবাবে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে দুটি পরমাণু অস্ত্রবাহী সাবমেরিন কৌশলগতভাবে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নির্দেশ দেন। এর আগে তিনি রাশিয়ার অর্থনীতিকে ‘মৃত অর্থনীতি’ বলে মন্তব্য করেন। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মেদভেদেভ যুক্তরাষ্ট্রকে সাবধান করে বলেন, ‘রাশিয়ার ডেড হ্যান্ড ব্যবস্থা এখনো সক্রিয়।’ এই ডেড হ্যান্ড হলো এমন এক স্বয়ংক্রিয় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যা দেশের নেতৃত্ব ধ্বংস হয়ে গেলেও পাল্টা হামলা চালাতে পারে। এই কৌশলের উদ্দেশ্য শত্রুকে ‘নিশ্চিত ধ্বংসের বার্তা’ দেওয়া।
ক্রেমলিন এখনো ট্রাম্পের পদক্ষেপের সরাসরি জবাব না দিলেও, রুশ পার্লামেন্টের উচ্চপর্যায়ের সদস্য ভিক্তর ভোডোলাতস্কি বলেন, “মহাসাগরে রাশিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিনের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। ট্রাম্প যেসব সাবমেরিন রাশিয়ার আশপাশে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন, সেগুলো দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের নজরদারিতে রয়েছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও শক্তির ভারসাম্য পুনর্গঠনের একটি কৌশলগত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। উভয় পরাশক্তি তাদের সাবমেরিন বাহিনীকে আধুনিকায়ন এবং যুদ্ধোপযোগী করে তুলতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর প্রধান কৌশলগত শক্তি হলো ওহাইও-ক্লাস ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিন, যেগুলো ‘বুমার’ নামে পরিচিত। এগুলোর অন্তত ১৪টি বর্তমানে সক্রিয়, এবং প্রতিটি সাবমেরিন ২০টি ট্রাইডেন্ট ডি৫ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম। সাবমেরিনগুলো ১৫ বছর পর্যন্ত বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই চলতে পারে, যা স্নায়ুযুদ্ধকালীন তৎপরতা বজায় রাখার প্রতীক।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ফাস্ট অ্যাটাক সাবমেরিনগুলোর মধ্যে রয়েছে ভার্জিনিয়া-ক্লাস, সিওউল্ফ-ক্লাস ও লস অ্যাঞ্জেলেস-ক্লাস। এগুলোতে থাকে টমাহক ও হারপুন ক্ষেপণাস্ত্র, এমকে-৪৮ টর্পেডো এবং মাইন বসানোর প্রযুক্তি। বিশেষ অভিযানে ব্যবহৃত ভার্জিনিয়া-ক্লাস ডুবোজাহাজ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আধুনিক প্ল্যাটফর্ম। লস অ্যাঞ্জেলেস-ক্লাস সাবমেরিনগুলো যদিও পুরোনো, তবুও এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন বাহিনীর মেরুদণ্ড।
রাশিয়ার সাবমেরিন বাহিনী সংখ্যায় এবং বৈচিত্র্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ। দেশটির বহরে রয়েছে প্রায় ৬৪টি সাবমেরিন, যার মধ্যে ১৪টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী (এসএসবিএন)। এই সাবমেরিনগুলো রাশিয়ার পারমাণবিক প্রতিরক্ষার প্রথম সারিতে রয়েছে।
আধুনিক বোরেই-ক্লাস সাবমেরিনে রয়েছে ১৬টি বুলাভা এসএলবিএম ও ৬টি টর্পেডো লঞ্চার। এগুলো ধীরে ধীরে ডেলটা ৪-ক্লাস সাবমেরিনের স্থান নিচ্ছে, যেগুলো এখনো সক্রিয় রয়েছে অন্তত ছয়টি। প্রতিটি ডেলটা সাবমেরিনে থাকে ১৬টি সিনেভা ক্ষেপণাস্ত্র।
রাশিয়ার আক্রমণাত্মক সাবমেরিনের মধ্যে ইয়াসেন-ক্লাস সবচেয়ে উন্নত ও কার্যকর। এটি কমসংখ্যক নাবিক দিয়ে পরিচালিত হয়, কিন্তু বহন করতে পারে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যালিবার বা অনিক্স ক্ষেপণাস্ত্র, যা দিয়ে সমুদ্র ও স্থলে লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা সম্ভব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগেও দুই পরাশক্তির এমন সামরিক প্রস্তুতি ও পাল্টা অবস্থান কেবল কূটনৈতিক সম্পর্ককেই জটিল করছে না, বরং সমগ্র বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য এটি উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক সাবমেরিন মোতায়েন, পারমাণবিক সক্ষমতা প্রদর্শন এবং প্রতিক্রিয়াশীল হুমকি বিনিময় বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
আপনার বিজ্ঞাপন এখানে